আজ বুধবার ৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারতে অনলাইনে ভয়াবহ মুসলিমবিদ্বেষী গান ছড়াচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা

কাশ্মীরে ২২ এপ্রিলের বন্দুকধারীদের হামলার পর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ভারতের ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছিল একটি উসকানিমূলক মুসলিম বিদ্বেষী গান। আকর্ষণীয় ছন্দে সাজানো এই গানে হামলার প্রতিশোধ নিতে সহিংসতার আহ্বান জানানো হয়েছে, একই সঙ্গে প্রকাশ্যে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গানটিতে মুসলিমদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিহ্নিত করা ছাড়াও তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গত ২৯ এপ্রিল আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইউটিউবে নতুন যে গান প্রকাশ পেয়েছে সেটির শিরোনাম, ‘পেহলে ধরম পুছা’ (তারা প্রথমে তাদের ধর্ম জানতে চেয়েছিল)। ওই গানের কথায় মুসলিমরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

ইউটিউবে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশিবার ওই গান দেখা হয়েছে। এটিই মুসলিমবিদ্বেষী একমাত্র গান নয়। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল–জাজিরা এমন আরও অন্তত ২০টি গান খুঁজে পেয়েছে। গানগুলোতে ইসলাম নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো ও বিদ্বেষমূলক কথা বলা হয়েছে। এগুলোই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ছড়ানো হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষ ও আতঙ্ক।

গানগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ভয়ংকর সব বর্ণনা রয়েছে। পেহেলগামে ভারতীয়দের ওপর হামলার পর তারা দাবি করেছে, বন্দুকধারীরা হিন্দু পর্যটকদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। ওই সব গানে এ বিষয়টির উল্লেখ করে বলা হয়, ‘ভারতীয় মুসলিমদের আর বিশ্বাস করা যায় না।’ অথচ বন্দুকধারীদের থামাতে গিয়ে একজন মুসলিম ঘোড়াচালক সেদিন প্রাণ হারিয়েছেন। আবার আহত পর্যটকদের উদ্ধারে স্থানীয় মুসলিমরা এগিয়ে এসেছেন।

গত সপ্তাহে উগ্র জাতীয়তাবাদী কিছু গানে পাকিস্তানকে পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে ধ্বংস করার ডাক দেওয়া হয়েছে। কিছু গানে ভারত সরকারের প্রতি পাকিস্তানকে ‘মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে’ বলা হয়েছে। আবার ‘পাকিস্তানিদের রক্তের বিনিময়ে পেহেলগামে নিহতদের প্রতিশোধ’ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন গ্রুপ থেকে গানগুলো অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা গানগুলো বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপে ছড়িয়ে ভারতীয়দের ভেতর ভয়, ঘৃণা এবং বিভাজন সৃষ্টির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

এমন প্রচারণায় ভারতের একাধিক রাজ্যে বাস্তবেও মুসলিমদের বাড়িঘরে হামলাসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও উত্তরাখণ্ডে মুসলিমদের ওপর হামলা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরি মুসলিমদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, রাস্তায় হকারদের মারধর করা হচ্ছে। প্রতিশোধমূলক আরও নানা কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন তারা। কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রে মুসলিম রোগীদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন হিন্দু চিকিৎসকেরা।

এরই মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের আগ্রায় একজন মুসলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদী এ হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছেন, পেহেলগামে হামলার প্রতিশোধ নিতে এটা করেছে সে।

এ ছাড়া এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিয়ে নানা ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে এবং হামলার সময়ের হৃদয় ছোঁয়া ইমেজ তৈরি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পেহেলগামে হামলার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে হামলা–সংক্রান্ত নানা কনটেন্টের বন্যা বইছে।

অধিকাংশ কনটেন্টের সুর প্রায় একই রকম, যেমন সেগুলোতে পেহেলগামে হামলার বিষয় এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যেন এটা হিন্দুত্ববাদ ও সনাতন ধর্মের ওপর হামলা ছিল। কোথাও কোথাও মুসলিমদের হুমকি বলে উল্লেখ করে হিন্দুদের একজোট হতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

আল–জাজিরা মুসলিমবিদ্বেষী যেসব গান পরীক্ষা করে দেখেছে, সেসবের একটির শিরোনাম, ‘জাগো হিন্দু জাগো’। এ গানে ‘দেশের ভেতরে বিশ্বাসঘাতকদের’ চিহ্নিত করতে বলা হয়। এখানে মূলত মুসলিমদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। গানের ভিডিওটি ইউটিউবে এ পর্যন্ত দেখা হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজারের বেশি। এতে পেহেলগামে হামলা নিয়ে এআই দিয়ে তৈরি কনটেন্টও ব্যবহার করা হয়েছে।

‘মোদি জি আব মহা যুধ হো জানে দো’ (মোদি, সেই মহান যুদ্ধ শুরু করুন) শিরোনামের আরেকটি গানে ভারতে বসবাসকারী মুসলিমদের ‘সাপের’ সঙ্গে তুলনা করা হয়। অন্য একটি গানে পেহেলগামের হামলাকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ভারতের হিন্দুদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয় অপর একটি গানে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কোনো পোস্টে পেহেলগাম হামলাকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং ভারত সরকারকে ইসরায়েলের দেখানো পথে প্রতিশোধ নিতে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।

পেহেলগামে হামলার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন সড়কে কাশ্মীরি ও মুসলিমদের লক্ষ্য করে অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)–এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২২ এপ্রিলের হামলার পর ভারতজুড়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও ঘৃণামূলক বক্তব্য দেওয়ার ২১টি ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরি নারী ও শিক্ষার্থীরাও নৃশংসতা এবং ঘৃণার শিকার হচ্ছেন।


তথ্যসূত্র:
1. ‘Traitors’: Hate-filled songs target Indian Muslims after Kashmir attack
– https://tinyurl.com/55yyr9ts

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *