আজ বুধবার ২৩শে জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাতিসংঘ অফিস বাংলাদেশে: মানবতা না ভূ রাজনৈতিক খেলা?

Channel IR। ডেস্ক রিপোর্টার

মুহাম্মাদ এমাদুল ইসলাম । ২২/০৭/২০২৫

জাতিসংঘ অফিস বাংলাদেশে: মানবতা না ভূ-রাজনৈতিক খেলা?

বাংলাদেশের শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, জনগণের উদ্বেগ ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ উপেক্ষা করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের (OHCHR) কার্যালয় স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিষয়টি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একাধিক গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

(১) জনগণের মতামত উপেক্ষিত:সরকারের এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এসেছে, যখন দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক চাপ বিদ্যমান। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি ও সময়জ্ঞান জনআস্থা ও গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলেছে।

(২) কারা সমর্থন করছে?সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ইসলামবিদ্বেষী নারীবাদী কয়েকটি সংগঠন স্বাগত জানিয়েছে, যারা পশ্চিমাদের লিঙ্গসমতা (gender equality), ঘৃণ্য পতিতাবৃত্তিকে সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান, সমাজ ধ্বংসকারী সমকামিতাসহ এলজিবিটিকিউ (LGBTQ)-এর মতো তথাকথিত মানবাধিকার নিয়ে তৎপর; অথচ নারীদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, অমানবিক শ্রম থেকে মুক্তি ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে তাদের কোনো উচ্চকণ্ঠ না থাকার কারণে তারা সর্বস্তরের জনগণের নিকট বিতর্কিত ও সমালোচিত। এছাড়া, এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে দেশে সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধোঁয়া তুলে দেশের উপর মার্কিন-ভারতের হস্তক্ষেপ আহ্বানকারী বিতর্কিত নেতৃত্ব। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ও তৎপরতা না থাকলেও মার্কিনীদের স্বার্থরক্ষায় তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ জনগণকে ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। এমনকি তারা অতিস্বল্প সময়ে মার্কিনীদের আনুগত্যের একের পর এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

(৩) রাজনৈতিক স্বার্থ বনাম সার্বভৌমত্ব:এই পদক্ষেপকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভূ-রাজনৈতিক আগ্রাসনের অংশ হিসেবে দেখছেন অনেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হীন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন সামরিক বাহিনীকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী তাদেরকে বিতর্কিত করেছে এবং তাদেরকে জনবিচ্ছন্ন করার চক্রান্ত করেছে; অথচ তারা ভারতীয় ষড়যন্ত্রে পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং সেনা অফিসারদের পরিবারের উপর পৈশাচিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে উচ্চবাক্য করে নাই। এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডেথ স্কোয়াড RAB-সহ সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে তথাকথিত জঙ্গিবাদ দমনের নামে ইসলামের দাওআহ্‌ বহনকারী এবং দেশের পক্ষে অবিচল রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে দমনে প্রশিক্ষণ-প্রযুক্তি-অস্ত্র প্রদান করে তাদেরকে অমানবিক কাজে ব্যবহার করেছে। মানবাধিকারের মুখোশধারী এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, তারা আদালতসহ রাষ্ট্র কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার নিয়ে স্পর্শকাতর তথ্য সংগ্রহ করে এবং যালিম শাসকের বিরুদ্ধে সক্রিয় নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ডাটা তৈরি করে এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে তাদের মিত্রদের সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে।

(৪) ইতিহাস আমাদের কী বলে?সিরিয়ায় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে যেখান থেকে তারা যালিম শাসক বাশারের বিরুদ্ধে লড়াইরত রাজনৈতিক কর্মী এবং বিদ্রোহীদের তথ্য মার্কিন দালাল বাশার আল আসাদ ও তাদের মিত্র রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে তাদেরকে দমনে সহযোগিতা করেছে। একইভাবে, ফিলিস্তিনে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে, যেখান হতে তারা মুসলিমদের দমনে ও গণহত্যায় গোপনীয় তথ্য অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের নিকট হস্তান্তর করেছে, যার দৃষ্টান্ত এখন বিশ্ববাসীর নিকট স্পষ্ট। একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের (UNHRC) একজন মানবাধিকার আইনজীবী এমা রেইলি বলেছিলেন, “চীনের কাছ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য UNHRC-এর উচ্চপদস্থ সদস্যরা সক্রিয়ভাবে উইঘুর ভিন্নমতাবলম্বীদের নাম চীনা শাসকগোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করছেন। অথচ পূর্ব তুর্কিস্তানের উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে চীন গণহত্যার নীতি অনুসরণ করা সত্ত্বেও এটি ঘটছে”। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের মুসলিম ভাই রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে মানবাধিকারের আড়ালে ‘মানবিক করিডোর’ বা ‘মানবিক চ্যানেল’ ইত্যাদি বাস্তবায়নে মার্কিনীরা তাদের ভূ-রাজনৈতিক হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে এবং তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করবে এতে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বমোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবিত এই ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল’ একটি সুগার কোটেড দুর্বৃত্ত প্রতিষ্ঠান। তাই এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেসব দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে সেই দেশের সাথে চুক্তিতে ‘দায় মুক্তির’ শর্ত সংযোজন করে। এই অভিজ্ঞতাগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শঙ্কা জাগায়—এই প্রতিষ্ঠান কি তথ্য সংগ্রহ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না?

৫) ইসলামি মূল্যবোধ ও পশ্চিমা এজেন্ডার সংঘাত:মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানের পশ্চিমা ধারণা অনেক সময় মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।জেন্ডার সমতা, সমকামিতা, যৌন স্বাধীনতা ইত্যাদি ইস্যুতে চাপ প্রয়োগ করে ধর্মীয় অনুশাসনকে ‘উগ্রবাদ’ আখ্যায়িত করা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর নয়, একটি জাতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অস্তিত্বের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।

(৬) দায়মুক্তির চুক্তি: রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি?OHCHR যেসব দেশে কাজ করে, সেখানে তারা প্রায়ই ‘দায়মুক্তি’র শর্তে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর অর্থ, তারা সেসব দেশে আইনত অনেক হিসাবের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে পারে। এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কতটা নিরাপদ—তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

(৭) এই সিদ্ধান্ত একটি ‘কার্যালয় স্থাপন’ মাত্র নয়:এটি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্ন।এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে রাষ্ট্রের উচিত ছিল, জাতীয় সংসদে আলোচনা করা, ধর্মীয় নেতৃত্বের মতামত নেয়া এবং সর্বোপরি জনগণের সম্মতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।রাষ্ট্র যদি নিজস্ব মূল্যবোধ ও স্বার্থ রক্ষা না করে, তবে আন্তর্জাতিক সংগঠনের মুখোশধারী হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং বিশ্বাসের ভিত্তিমূল দুর্বল করে দিতে পারে। এই মুহূর্তে দেশের সব বিবেকবান নাগরিকের উচিত হবে—শান্তি, স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্নে সচেতন, সংবেদনশীল ও সাহসী অবস্থান গ্রহণ।

আবু সুফিয়ান লেখক ও সাংবাদিক

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *