আজ শুক্রবার ১৪ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসলামের তারকাগণ || পর্ব-২৭ || শামিল বাসায়েভ রাহিমাহুল্লাহ; আগ্রাসী রাশিয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া এক চেচেন বীর || ( চতুর্থ কিস্তি)

❝চলমান চেচেন যুদ্ধ ততদিন পর্যন্ত বন্ধ হবে না, যতদিন না প্রতিটি রাশিয়ান যুদ্ধের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করে নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়া আমাদের ৪০ হাজারেরও বেশি শিশুকে হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার শিশুকে বিকৃত করেছে। এ বিষয়ে কেউ কি কিছু বলছে?…এর দায় পুরো রাশিয়ান জাতির, যারা নীরবতার মাধ্যমে রাশিয়ান সরকারকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।❞ 

— চেচেন কমান্ডার শামিল বাসায়েভ

আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ-শিবিরে শামিল বাসায়েভ:

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, শামিল বাসায়েভ ২০০১ সালে আফগানিস্তান গমন করেন এবং বৈশ্বিক জিহাদী সংগঠন আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ-শিবির থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। উক্ত তথ্যে আরও ওঠে এসেছে যে, শামিল বাসায়েভ এবং আমীর আল-খাত্তাব আফগানিস্তানে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বাহিনীর (১) বিরুদ্ধে যুদ্ধরত —০৫৫ ব্রিগেড (২) ও তালিবান মুজাহিদদের সহায়তা করার জন্য যোদ্ধাও প্রেরণ করেছিলেন। তিনি আফগানিস্তান থেকে আল-কায়েদা ও তালিবানের যুদ্ধনীতি রপ্ত করেন এবং ঊর্ধ্বতন কমাণ্ডারদের থেকে দিকনির্দেশনা নিয়ে পুনরায় চেচনিয়ায় ফিরে আসেন।

আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসার পর শামিল বাসায়েভ শাহাদাতের নেশায় উন্মাদের মতো হয়ে যান। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এমন সব হামলার নেতৃত্ব দিতে থাকেন যে, চেচনিয়ার এই একজন মাত্র বিদ্রোহী নেতার কারণে সমগ্র রাশিয়ার ঘুম হারাম হয়ে যায়। উপায়ান্তর না পেয়ে রাশিয়া নিজেদের ভীরু ও কাপুরুষ পূর্বসূরিদের সেই চিরচেনা পদ্ধতিই অবলম্বন করে— অর্থাৎ, “মাথার মূল্য ঘোষণা”।

মাথার মূল্য ঘোষণা:

২০০১ সালের ২ জুন চেচনিয়ায় রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল গেন্নাদি টর্চেভ শামিল বাসায়েভের মাথা নিয়ে আসা ব্যক্তির জন্য ১ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। এছাড়াও ২০০৪ সালে রাশিয়ান সরকার শামিল বাসায়েভকে গ্রেপ্তারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানকারীকে ৩০০ মিলিয়ন রুবেল (প্রায় ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পুরুস্কার প্রদানের ঘোষণা করে। কিন্তু রাশিয়ার এসব প্রলোভনপূর্ণ ঘোষণা বাসায়েভের একান্ত-ঘনিষ্ঠজনদের মাঝে কোনোরূপ প্রভাব ফেলেনি৷ ইতোপূর্বেও শেরে দাগিস্তান ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ-র মাথার চড়া মূল্য ঘোষণা করেছিল রাশিয়ার একাধিক সেনাপতি। বস্তুত প্রতিজন মুসলিম নেতার মাথাকে কাফেররা এত চড়া মূল্য দিয়ে কিনে নিতে চায়, যার এক সিকি ভাগও মুসলিম নেতারা বড় থেকে বড় কোনো কাফেরের মাথার বিনিময়েও ব্যয় করতে প্রস্তুত নন। এজন্যই শেরে দাগিস্তান ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ সেনাপতি নেডহার্ডের এরকম এক ঘোষণার পর পত্র মারফত তাকে বলেছিলেন: তোমার মাথা কেন; তোমার জারের (জার মানে তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) মাথাও যদি কেউ আমার কাছে নিয়ে আসে তাহলে তাকে আমি একটা কানাকড়িও দেব না; কারণ, একটা কানাকড়িও তোমার ও তোমার জারের মাথার চেয়ে বেশি মূল্যবান।

“রিয়াদুস সালিহিন ব্রিগেড অব মার্টায়ারস”- প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম: ( Riyad-us Saliheen Brigade of Martyrs )

১৯৯৯ সালের অক্টোবরে চেচেনদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা শামিল বাসায়েভ রাশিয়ার গ্রোজনি হামলার প্রতিশোধ গ্রহণ ও সমগ্র চেচনিয়া থেকে রুশ সেনাদের বিতারিত করার লক্ষ্যে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ইতোপূর্বে বাসায়েভ ও আমীর আল-খাত্তাবের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আইআইপিবি গঠিত হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান পরিচালিত হয়ে আসছিল, তথাপি এ সংগঠনটিকে ভিন্ন একটি মহৎ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়৷ সেটি হলো, রুশ সেনাদের উপর ইস্তিশহাদী বা আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করা।

শামিল বাসায়েভ অনেক ভেবেচিন্তে দেখলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হলে শুধু গেরিলা যুদ্ধ যথেষ্ট না। এখানে প্রচুর পরিমাণে আত্মঘাতী হামলার প্রয়োজন। সে প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তেই তিনি রিয়াদুস সালিহিন ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেন। ফেব্রুয়ারী এবং মার্চ ২০০৩ সালে সংগঠনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পরবর্তীকালে জাতিসঙ্ঘ দ্বারা একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলটি সক্রিয়ভাবে নিজদের আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করতে থাকে। এরপর বিভিন্ন কারণে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ২০০৯ সালে ককেশাস আমিরাত দ্বারা সংগঠনটি পুনরায় সক্রিয় করা হয় সাইদ বুরিয়াতস্কির কমান্ডের অধীনে। তার মৃত্যুর পরে, আসলান বিউতুকায়েভ এর নতুন নেতা নির্বাচিত হন।

ব্ল্যাক উইডো বা শাহিদকা:

শামিল বাসায়েভ আত্মঘাতী হামলার জন্য রিয়াদুস সালিহিন ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু এর জন্য আত্মঘাতী সৈন্য রিক্রুট করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই একাজের জন্য তিনি রুশ-চেচেন যুদ্ধে নিহত পুরুষদের বিধবা স্ত্রীদের কাজে লাগানোর আইডিয়া আবিষ্কার করেন। কেননা, স্বামীহারা এসব নারীদের অন্তর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেন এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিল। স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদেরকে বিলীন করে দিতে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত ছিলেন না। যেকোনোভাবেই হোক, তারা শুধু চান প্রতিশোধ নিতে। বাসায়েভ এমন বিধবা নারীদের খুঁজে খুঁজে প্রশিক্ষণ দেন। এক বক্তব্যে তিনি বলেছেন- আমি নিজেই কমপক্ষে ৫০ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিধবাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

বাসায়েভের প্রশিক্ষিত এসকল বিধবারা ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আত্মঘাতী হামলায় সক্রিয় ছিলেন। এসময়ের মধ্যে চালানো আত্মঘাতী হামলাগুলোর ৬৫% এরও বেশি হামলা এসব বিধবা নারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে তারা অক্টোবর ২০০২ সালে মস্কো থিয়েটার জিম্মি অপারেশনে (৩) অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। শামিল বাসায়েভের প্রশিক্ষিত এসব বিধবা মহিলারাই আন্তর্জাতিক বিশ্বে ব্ল্যাক উইডো বা শাহিদকা নামে সমধিক পরিচিত, যাদেরকে শামিল বাসায়েভ রিয়াদুস সালিহিন ব্রিগেডের অংশ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।



নোট:

(১) নর্দার্ন অ্যালায়েন্স, আনুষ্ঠানিকভাবে “ইউনাইটেড ইসলামিক ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর দ্য স্যালভেশন অফ আফগানিস্তান” নামে পরিচিত। এটি মূলত আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ একটি সশস্ত্র দল, যা ১৯৯৬-২০০১ সালের তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। দলটির অন্যতম প্রধান ছিল রাষ্ট্রপতি বুরহানউদ্দিন রাব্বানী এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আহমদ শাহ মাসুদ। দলটি ভারত, ইরান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উজবেকিস্তানের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল। ২০০১ সালের মধ্যে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স দেশের ১০% এরও কম নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
(২) ০৫৫ ব্রিগেড ছিল শাইখ উসামা বিন লাদেন রাহিমাহুল্লাহর অনুগত একটি গেরিলা সংগঠন, যা আল-কায়েদা দ্বারা স্পনসর এবং প্রশিক্ষিত ছিল এবং ১৯৯৫ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে ইসলামী ইমারাতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তালেবানের সাথে একজোট হয়ে কাজ করেছিল।
(৩) মস্কো থিয়েটার জিম্মি অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ আগামী পর্বে আসছে ইনশাআল্লাহ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *